বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্র: সম্ভাবনা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর পথ -শহীদ রায়হান চলচ্চিত্র নির্মাতা

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ভাঙা-গড়ার এই অভিযাত্রায় কোথায় আছে আমাদের সম্ভাবনা? কোথায় রয়ে গেছে বাধা? আর কোন পথে হাঁটলে সম্ভব পুনর্জাগরণ? এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করা হয়েছে বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্রের বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও এগিয়ে চলার রূপরেখা।

বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ২০০০-এর দশক পর্যন্ত মানহীন কন্টেন্ট আর হলিউড-বলিউডের নকল কাহিনীর আধিক্যে দর্শকরা দেশীয় সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, যার ফলে অগণিত প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যায়। তবে সাম্প্রতিক বছরে বেশ কিছু চলচ্চিত্রের সাফল্যে আবারও আশার সঞ্চার হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কয়েকটি ছবির অভূতপূর্ব সফলতা প্রমাণ করেছে যে ভালো গল্প ও নির্মাণ দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে পারে । উদাহরণসরূপ, ২০১৬ সালের “আয়নাবাজি”, ২০২২ সালের “হাওয়া” এবং ২০২৩ সালের ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত “প্রিয়তমা” অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রিয়তমা তো দেশীয় বক্স অফিসে সকল পূর্ববর্তী আয়ের রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রায় ৪১.২৩ কোটি টাকা আয় করে, যেখানে ১৯৮৯ সালের কিংবদন্তী সিনেমা “বেদের মেয়ে জোসনা” এর আয় ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ, একসময়ে যে দর্শক হলবিমুখ ছিল, এখন মানসম্মত বিনোদন পেলে তারা আবার হলে ফিরছে । দেশের প্রধান তারকা অভিনীত বাণিজ্যিক ছবিগুলো তো আছেই, পাশাপাশি ভিন্নধর্মী গল্পের চলচ্চিত্রও সাড়া পাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, ঢালিউডের বক্স অফিসে এখন কিছুটা জৌলুস ফিরতে শুরু করেছে এবং দর্শক অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। সাম্পতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া “জংলী, বরবাদ ও দাগি” চলচ্চিত্রের দর্শক জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে চলচ্চিত্র অংগণে আশার সঞ্চার করেছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র বিনোদনের জগতে এক নতুন খেলোয়াড়ের আবির্ভাব ঘটেছে – ওটিটি (OTT) প্ল্যাটফর্ম। ইন্টারনেটের প্রসার এবং স্মার্টফোন ব্যবহারের বিস্ফোরণের কারণে বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী এখন ঘরে বসেই সিনেমা-নাটক দেখার সুযোগ পাচ্ছে। ২০২১ সালে উদ্বোধন হওয়া দেশীয় স্ট্রিমিং সার্ভিস চরকি মাত্র এক বছরে ৫০টিরও বেশি মৌলিক চলচ্চিত্র ও সিরিজ মুক্তি দিয়ে বিনোদন জগতে রেকর্ড গড়েছে । ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর উত্থানে বৈচিত্র্যময় গল্প বলার প্রবণতা বেড়েছে এবং অনেক উদ্ভাবনী নির্মাতা সেন্সরের চাপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে কনটেন্ট তৈরি করতে পারছেন । উদাহরণস্বরূপ, তরুণ পরিচালক নুহাশ হুমায়ূনের ওটিটি রিলিজ “ পেট কাটা ষ” স্থানীয়ভাবে ভৌতিক ঘরানায় নতুন ধারা যোগ করেছে এবং তার স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র “মশারি” আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত হয়েছে। ওটিটির জন্য তৈরি ওয়েব সিরিজ “মহানগর”, “তাকদীর” বা “কন্ট্রাক্ট”-এর মতো কন্টেন্টও আলোচনায় এসেছে। অন্যদিকে, বিদেশি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সেও কিছু বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ও কন্টেন্ট স্থান পাচ্ছে। ফলে ওটিটি একদিকে প্রথাগত হলকেন্দ্রিক ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ তৈরি করলেও, অন্যদিকে এটি নির্মাতাদের জন্য নতুন পরিসর ও দর্শকদের কাছে বিকল্প মাধ্যম হয়ে এসেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বাজার একই সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহের বড় পর্দা এবং অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের ছোট পর্দা – দুটির সমন্বয়ে এগোচ্ছে।

বিদ্যমান সমস্যা
চলচ্চিত্র শিল্পে আশার আলো দেখা দিলেও এখনো নানাবিধ কাঠামোগত সমস্যা রয়ে গেছে। প্রথমত, দেশের বহু সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রদর্শন অবকাঠামো সীমিত হয়ে পড়েছে। একসময় দেশে এক হাজারের বেশি চলচিত্র হল ছিল, যা এখন কমতে কমতে ৭০ থেকে ১২০ এ নেমে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। গত দশকে প্রতি বছর যেখানে শতাধিক ছবি মুক্তি পেত, বর্তমানে বছরে গড়ে ৫০টিরও কম চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অনেক নির্মাতা বিনিয়োগ তুলে আনতে পারছেন না, আবার দর্শকরাও আশপাশে হল না থাকায় সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একসময়কার পতনের ধারা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
দ্বিতীয়ত, সেন্সর বোর্ডের কঠোর ও কখনো অস্পষ্ট নীতিমালা সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত করছে। স্বাধীনভাবে গল্প বলার ক্ষেত্রে সেন্সরের আগাম হস্তক্ষেপ অনেক পরিচালককেই সমস্যায় ফেলছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড বা সার্টিফিকেশন বোর্ড প্রায়শই চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুর ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেয়, যা মাঝে মাঝে অতিরিক্ত রক্ষণশীল বলে সমালোচিত। উদাহরণ হিসেবে, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর বহুল প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র “শনিবার বিকেল” ২০১৯ সালে জমা দেওয়ার পর চার বছর ধরে আটকে ছিল সেন্সর বোর্ডে। হলি আর্টিজান হামলার ছায়া আছে বলে সন্দেহে এই চলচ্চিত্রটি বারবার ছাড়পত্র পায়নি; শেষমেশ ২০২3 সালে এসে বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে (প্রারম্ভে ডিসক্লেমার যুক্ত করে) এটি মুক্তির অনুমতি পায়। এ ছাড়াও শহীদ রায়হানের “মনোলোক” ২০২২ সাল থেকে এখনো কোন প্রকার কারণ ছাড়াই সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে, এমন আরো বেশ কিছু চলচ্চিত্রের ভবিষ্যত এখনো অনিশ্চিত। এত দীর্ঘ সময় সেন্সরে আটকে থাকায় চলচ্চিত্র গুলোর ব্যবসায়িক সম্ভাবনা যেমন মার খেয়েছে, তেমনি পরিচালক সহ পুরো ইন্ডাস্ট্রির মনোবলে আঘাত লেগেছে। অনেকে মনে করেন, সেন্সরবোর্ডের সুস্পষ্ট নির্দেশিকার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং রাজনৈতিক-সামাজিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করায় সৃজনশীল স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে । ফলস্বরূপ, সংবেদনশীল সামাজিক বা রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে ছবি তৈরি করতে পরিচালকরা নিরুৎসাহিত বোধ করছেন।
তৃতীয়ত, পাইরেসি বা অননুমোদিত কপি ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ডিজিটাল যুগে সিনেমা মুক্তির কয়েক দিনের মধ্যেই অনেক চলচ্চিত্র অনলাইনে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, যা নির্মাতা ও প্রযোজকদের জন্য “মরার উপর খাঁড়ার ঘা” হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে তারা মন্তব্য করেন । উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের আলোচিত ছবি “সুরঙ্গ” এবং শাকিব খান অভিনীত “দরদ” মুক্তির পর পরই অনলাইনে পাইরেটেড কপি ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি “তুফান” নামক বিগ বাজেট ছবিটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে প্রকাশের তৃতীয় দিনেই পুনরায় পাইরেসির শিকার হয়েছিল। জনপ্রিয় ও প্রতীক্ষিত সিনেমাগুলোই বেশি পাইরেটেড হচ্ছে, যার ফলে দর্শকের একটি অংশ হল বা বৈধ প্ল্যাটফর্ম বাদ দিয়ে ফ্রি তে অনলাইনে দেখে নিচ্ছেন। এতে করে যারা বিনিয়োগ করেছেন তারা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং ইন্ডাস্ট্রির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে। কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও পাইরেসি পুরোপুরি থামানো যাচ্ছে না, যা চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
চতুর্থত, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং পেশাগত দক্ষতার ঘাটতিও উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হলে উন্নত ক্যামেরা, সাউন্ড সিস্টেম, ভিএফএক্স ও আধুনিক পোস্ট-প্রোডাকশন সুবিধা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্টুডিও ও নির্মাতাদের সে পর্যায়ের যন্ত্রপাতি বা বাজেট নেই। ভিএফএক্স-সমৃদ্ধ বা কারিগরিভাবে জটিল ছবি নির্মাণের দক্ষ জনবলও কম। চলচ্চিত্র নির্মাণে ডিজিটাল প্রযুক্তির পূর্ণাঙ্গ উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে যে প্রশিক্ষিত কর্মশক্তি দরকার, তার অভাব রয়েছে বলে গবেষণাতেও উঠে এসেছে । এক গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, দক্ষ জনবল তৈরি ছাড়া ডিজিটাল যুগে চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়ন সম্ভব নয় এবং এই খাতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা জরুরি । সুতরাং প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা ও দক্ষতার অভাব আমাদের চলচ্চিত্রকে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া উপযুক্ত বিনিয়োগের অভাব, পেশাদার প্রযোজনা ও বিতরণ ব্যবস্থার সংকট এবং হল মালিকদের অনেকের ব্যবসায়িক অনাগ্রহও বর্তমান সমস্যার অংশ বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন।
সম্ভাবনা
অত্যধিক চ্যালেঞ্জের মাঝেও বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্রে উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বারও খুলতে শুরু করেছে। উল্লেখযোগ্য একটি সম্ভাবনা হলো নতুন প্রজন্মের উদীয়মান পরিচালকদের আবির্ভাব। তরুণ নির্মাতারা নতুন চিন্তা ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসছেন, যা ইতোমধ্যে বেশ কিছু সফল ও প্রশংসিত ছবির মাধ্যমে প্রমাণিত। যেমন, রায়হান রাফী, মেজবাউর রহমান সুমন, নুহাশ হুমায়ূন, আশফাক নিপুণদের মতো নির্মাতারা গত কয়েক বছরে ভিন্নধর্মী গল্প ও নির্মাণশৈলী উপস্থাপন করে চলচ্চিত্রে সতেজ হাওয়া বইয়ে দিয়েছেন। এদের ছবিতে বাস্তববাদিতা, সামাজিক ইস্যু এবং নতুন ধরণের ঘরানা (হরর, থ্রিলার ইত্যাদি) স্থান পাচ্ছে, যা নগরীয় তরুণ দর্শক থেকে শুরু করে সব শ্রেণির দর্শকদের আকর্ষণ করছে। উদাহরণস্বরূপ, রায়হান রাফীর “পরাণ” ও “দামাল” বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে, আবার আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের “রেহানা মরিয়ম নূর” দেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে কান চলচ্চিত্র উৎসবে অফিসিয়াল নির্বাচিত হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে। এসব সাফল্যপ্রসূত তরুণদের হাত ধরে দেশীয় চলচ্চিত্র নতুন ভাষা ও ব্যকরণ খুঁজে পাচ্ছে। নতুন নির্মাতাদের নতুন ধারার কাজের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে বৈচিত্র এসেছে এবং সাম্প্রতিক কিছু প্রকল্প আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতেও পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম একটি বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ওটিটির কল্যাণে শুধু বড় বাজেটের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নয়, বরং ভিন্নধর্মী ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী কনটেন্টও এখন দর্শক পাচ্ছে। দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো স্বল্প বাজেটে মানসম্মত মৌলিক সিনেমা ও ওয়েব সিরিজ তৈরি করে দেখিয়েছে যে ভালো গল্প হলে দর্শক তা যে মাধ্যমে হোক গ্রহণ করবে। ওটিটিতে নবীন নির্মাতারা সিনেমা তৈরির সুযোগ পাচ্ছেন এবং অনেক নতুন অভিনেতাও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। বিশেষত চরকি, হইচই,, বঙ্গ , বাংলাফ্লিক্স প্রভৃতি প্ল্যাটফর্ম স্থানীয় কনটেন্টে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এক বিকল্প বাজার হয়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক পরিসরে Netflix, Amazon Prime-এর মতো প্ল্যাটফর্মেও যদি বাংলাদেশি কন্টেন্ট স্থান পেতে শুরু করে, তবে বৈশ্বিক দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ রয়েছে। সুতরাং ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো একদিকে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করলেও দীর্ঘমেয়াদে এটা চলচ্চিত্রশিল্পের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
তৃতীয়ত, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতিগত উদ্যোগসমূহ সম্ভাবনার জায়গা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে প্রতি বছর চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দিয়ে আসছে । সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও এই অনুদানের পরিমাণ ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে; যেমন কোভিড-পরবর্তীতে এক বছরে সর্বাধিকসংখ্যক চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়া হয় শিল্পকে চাঙা করতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৯টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে সরকার অনুদান দিয়েছে যা পরিচালক ও কলাকুশলীদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা হয়েছিল। এসব সরকারি অনুদান মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ, শিশুতোষ বা শিল্পঘন চলচ্চিত্র তৈরিতেও উৎসাহ জোগাচ্ছে। তাছাড়া সরকার সম্প্রতি চলচ্চিত্র উন্নয়নের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন, চলচ্চিত্র শিল্পকে রক্ষা ও হল বাঁচাতে বিদেশি সিনেমা নিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় চলচ্চিত্র নীতি প্রণয়ন নিয়ে কাজ চলছে বলে জানা যায়। ২০২৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে প্রতি বছরে ১০টি করে ভারতীয় ছবি আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বিশেষ শর্তসাপেক্ষে, যাতে করে দর্শক হলমুখী হয় এবং হল মালিকরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারেন। এই সিদ্ধান্তটি হলে দর্শক টানতে সাময়িকভাবে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে, যদিও দেশীয় চলচ্চিত্রের জন্য এটি একদিকে চ্যালেঞ্জও বটে। সরকারের পক্ষ থেকে চলচ্চিত্রের উন্নয়নে আধুনিক প্রযোজনা সুবিধা স্থাপন, আঞ্চলিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র তৈরি, কর অব্যাহতি ইত্যাদিও ভবিষ্যতে দেওয়া হতে পারে। এসব উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে চলচ্চিত্র শিল্পের পুনর্জাগরণ সহজতর হবে।
চতুর্থত, বাংলাদেশের বিশাল যুবসমাজ এবং বৈশ্বিক বাংলা ভাষাভাষী দর্শকগোষ্ঠীও একটি সম্ভাবনাময় বাজার। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ, যারা ভালো মানের কনটেন্ট পেলে সেটিকে দ্রুত জনপ্রিয় করে তুলতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে মুখে মুখে প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ায় এখন ভালো চলচ্চিত্র বা ওয়েব সিরিজ রাতারাতি ট্রেন্ড হয়ে যায়, যা বাজার সম্প্রসারণে সহায়ক। একই সাথে প্রবাসী বাংলাদেশি ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি দর্শকরাও এখন বাংলাদেশি ছবির প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সাম্প্রতিককালে “পরাণ”, “হাওয়া”, “শান” কিংবা “শুড়ঙ্গ” এর মতো চলচ্চিত্র বিদেশের বিভিন্ন শহরে প্রবাসীদের জন্য প্রদর্শিত হয়েছে এবং ভালো সাড়া পেয়েছে। প্রযোজকরা আন্তর্জাতিক মুক্তির কথা মাথায় রেখে বিনিয়োগের মাত্রা বাড়ানোর কথা ভাবছেন। এসব ইঙ্গিত দেয় যে সঠিক পরিকল্পনা ও প্রচারণা পেলে বাংলাদেশের ছবি উপমহাদেশ ছাড়িয়ে বৈশ্বিক বাজারেও সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
ঘুরে দাঁড়ানোর পথ
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে ঘুরে দাঁড় করাতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সর্বপ্রথম প্রয়োজন গল্প ও নির্মাণে মান নিশ্চিত করা। দর্শক এখন অনেক সচেতন এবং বিকল্প বিনোদনের অভাব নেই; তাই গতানুগতিক বা দুর্বল গল্পের ছবি দিয়ে তাদের টানা যাবে না। মৌলিক চিত্রনাট্য উন্নয়নে বিনিয়োগ করা, ভালো লেখক ও পরিচালক তৈরি করা এবং চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউটগুলোতে প্রশিক্ষণের মান বাড়ানো জরুরি। সৃজনশীলতা চাঙ্গা করতে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে স্ক্রিপ্ট রাইটিং প্রতিযোগিতা, চলচ্চিত্র কর্মশালা ইত্যাদি আয়োজন করা যেতে পারে। নির্মাতাদের নতুন ধরণের ঘরানা অন্বেষণে উৎসাহিত করতে হবে এবং ব্যর্থতা হলেও শাস্তির ভয়ে যেন তারা পিছিয়ে না পড়েন, তা নিশ্চিত করতে হবে। গুণগত মানের সঙ্গে কোন আপস না করেই নিয়মিত ভালো গল্পের ছবি উপহার দিতে পারলেই দর্শক আস্থা ফিরে পাবে এবং হলে ফেরার প্রবণতা বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মান অর্জনে ক্যামেরা, শব্দ, এডিটিং, ভিএফএক্স ইত্যাদিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রীয় বা বেসরকারি বিনিয়োগে অত্যাধুনিক স্টুডিও ও পোস্ট-প্রোডাকশন সুবিধা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি, এই সরঞ্জাম চালানোর জন্য দক্ষ জনবল তৈরিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে। ফিল্ম ইন্সটিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তিনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যাতে নতুন প্রজন্ম শুরু থেকেই ডিজিটাল সিনেমার কৌশল রপ্ত করতে পারে। গবেষণায়ও বলা হয়েছে, উপযুক্ত জনবল উন্নয়ন ছাড়া ডিজিটাল প্রযুক্তির পূর্ণ সুবিধা পাওয়া যাবে না। ফলে সরকার-নির্মাতা-একাডেমি গুলো মিলে দক্ষ কর্মী গড়ে তোলা ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হওয়া উচিত।
তৃতীয়ত, সেন্সরবোর্ড বা সার্টিফিকেশন বোর্ড নীতিমালা সংস্কার ও প্রেক্ষাগৃহ অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। সেন্সর বোর্ড গঠণের ক্ষেত্রে ব্যাপক নীতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। সেন্সর বোর্ডকে সময়োপযোগী ও স্বচ্ছ গাইডলাইন প্রদান করতে হবে যাতে নির্মাতারা আগেভাগেই জানেন কী ধরনের বিষয়বস্তু গ্রহণযোগ্য আর কী নয়। কাল্পনিক গল্প ও বাস্তব ঘটনার পার্থক্য বোঝানো, সাবলীল ভাষা ব্যবহারে ছাড় দেওয়া, এবং শুধুমাত্র জাতীয় নিরাপত্তা কিংবা গুরুতর সামাজিক সংহতি বিপন্ন হলে সেন্সরশিপ আরোপ – এমন নীতিমালা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। এর পাশাপাশি, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে সারা দেশে পুরনো বন্ধ সিনেমা হলগুলো আধুনিকায়ন করে চালু করা ও নতুন মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণ জরুরি। সরকার ট্যাক্স ইনসেনটিভ বা ভর্তুকি দিয়ে হলেও বিভাগীয় শহর ও পর্যটন এলাকাগুলোতে মাল্টিপ্লেক্স স্থাপনে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। হল মালিকদের সহজ ঋণ সুবিধা, সরঞ্জাম আমদানিতে কর ছাড় ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। প্রেক্ষাগৃহ বেড়ে গেলে এবং সেগুলোতে পরিবার-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে মানুষ আবার বড় পর্দায় সিনেমা উপভোগের অভ্যাস ফিরে পাবে। সম্প্রতি কিছু বন্ধ হল পুনরায় খোলার খবর যেমন এসেছে, তেমনি স্টার সিনেপ্লেক্সের মতো আধুনিক হলের সংখ্যা বাড়ছে – এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
চতুর্থত, বাজার প্রসার ও পাইরেসি দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে দর্শকসংখ্যা সীমিত, তাই পাশের দেশ ভারত (বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ) ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বড় মার্কেট কাজে লাগাতে হবে। যৌথ প্রযোজনা এবং ভিন্ন ভাষায় ডাবিং করে বাংলাদেশি ছবি প্রতিবেশী দেশগুলোতে মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে নির্মাতারা বড় বাজেটের ছবি নির্মাণের ঝুঁকি নিতে পারবেন, কারণ শুধু দেশীয় বাজারের আয় দিয়ে লগ্নি উঠে আসা কঠিন। একই সঙ্গে, পাইরেসি রোধে কঠোর মনিটরিং ও আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সিনেপ্লেক্সগুলোতে ক্যামেরা বা মোবাইলে রেকর্ডিং ঠেকাতে বাড়তি সতর্কতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে হল কর্তৃপক্ষকে উৎসাহিত করতে হবে। অনলাইনেও যেসব সাইট বা সামাজিক পেজ পাইরেটেড কন্টেন্ট ছড়ায়, সাইবার ক্রাইম ইউনিটের মাধ্যমে দ্রুত সেগুলো বন্ধ করা ও জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শিল্পী, পরিচালক ও দর্শকদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়াতে হবে যাতে কেউ পাইরেটেড সংস্করণ না দেখেন। শিল্পী ও কলাকুশলীদের রুটি-রুজি রক্ষায় পাইরেসি দমন করতেই হবে – অন্যথায় হাতে গোনা যে কটি ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে, সেগুলোও বানিজ্যিক ক্ষতির মুখে পড়ে ইন্ডাস্ট্রিকে পিছিয়ে দেবে।
সবশেষে, সমন্বিত ভাবে সরকার, চলচ্চিত্র পরিবারের সদস্য এবং দর্শক সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সরকারের উচিত দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় চলচ্চিত্র নীতি বাস্তবায়ন করা, যেখানে উৎপাদন থেকে প্রদর্শন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে উন্নয়ন ও সহায়তার রূপরেখা থাকবে। প্রযোজক, পরিবেশক ও হল মালিকদের পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে, যেমন উৎসব মৌসুম ছাড়া অন্যান্য সময়েও ভালো ছবি মুক্তি দিয়ে সারা বছরে চলচ্চিত্র ব্যবসা সচল রাখা সম্ভব। এছাড়া চলচ্চিত্র বিপণন ও প্রচারেও নতুন কৌশল আনতে হবে যাতে তরুণ প্রজন্মকে হলে আকৃষ্ট করা যায়। গুণী নির্মাতা ও শিল্পীদের কাজের স্বীকৃতি দিতে জাতীয় পুরস্কার ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল এবং নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করলে শিল্পে প্রতিযোগিতা ও উদ্দীপনা বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্রে যে পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে, তা ধারাবাহিক রাখতে পারলেই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। বর্তমান প্রজন্মের মেধাবী নির্মাতাদের সৃষ্টিশীলতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও উদ্ভাবনী ভাবনাকে পুঁজি করে সামনে এগোতে হবে। একই সঙ্গে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে। যথাযথ বিনিয়োগ, পরিকল্পনা ও মুক্ত চিন্তার পরিবেশ পেলে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প আবার স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে বাংলাদেশের সিনেমা কেবল ঘরোয়াভাবে ঘুরে দাঁড়াবে তা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিযোগিতামূলক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে – এটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক পরিচিতি:
শহীদ রায়হান, চলচ্চিত্র নির্মাতা। ৩ শতাধিক বিজ্ঞাপন, টিভি নাটক, টিভি রিয়েলিটি শো ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্র ও ডিজিটাল কনটেন্ট দেশ-বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, ডিরেক্টরস গিল্ড ও অ্যাক্টরস ইকুইটির সদস্য।