শহীদ রায়হান, চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক।
মানবশিশুর প্রথম কান্নাটি কেবলই শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া নয়, বরং তা নবজাতকের প্রথম ভাষাগত যোগাযোগ। জন্মের পরপরই শিশুটি চিৎকার করে যেন বিশ্বের কাছে ঘোষণা করে তার অসহায়ত্ব এবং তৎক্ষণাৎ মায়ের স্নেহ ও যত্নের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করে। বাস্তবে এই কান্নার মাধ্যমে নবজাতক মায়ের করুণা “ভিক্ষা” করে নেয় – ক্ষুধা, নিরাপত্তা ও সান্নিধ্যের আকুতি জানায়। এইভাবে জীবনের সূচনা থেকেই মানবসন্তান অন্যের সহায়তার জন্য হাত পাততে শেখে। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মানবজীবন নানান চাহিদা ও প্রত্যাশায় ভরপুর, যা পূরণের জন্য মানুষ অবচেতনে প্রকৃতি, সমাজ কিংবা কোন এক উচ্চতর শক্তির দ্বারস্থ হয়। এই প্রবন্ধে দর্শন, সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হবে কেন বলা যায় যে জন্মগতভাবেই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ একপ্রকার ভিক্ষুক।
জন্মের ক্ষণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ নানাবিধ মৌলিক ও মানসিক চাহিদার দ্বারা চালিত। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় মানবচরিত্র মূলত নানা প্রয়োজন পূরণের তাগিদে প্রবৃত্ত থাকে। শিশুকালে এই প্রয়োজন অত্যন্ত সরল – খাদ্য, সুরক্ষা ও স্নেহ। শিশুর কান্না তার চাহিদার সংকেত বহন করে এবং এটি মূলত অভিভাবকের সুরক্ষা ও মমতা পাওয়ার জন্য এক ধরনের আবেদন । মনস্তত্ত্ববিদ জন বাউলবি ও মার্গারেট এইন্সওর্থের সংযুক্তি তত্ত্ব অনুযায়ী, শিশুর কান্না জন্মগত একটি সংযুক্তিকরণ আচরণ যা মূলত পিতামাতার সান্নিধ্য ও রক্ষাকবচ পাওয়ার আবেদনমাত্র। এই প্রাথমিক অসহায়ত্ব কাটিয়ে উঠতে সন্তানের যা ভরসা, তা হলো চারপাশের বড়দের ত্বরিত সাড়া পাওয়া – প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি শিশুর কান্নাকে এমন তীব্র করে গড়ে তুলেছে যেন তা শুনে বড়োরা দ্রুত পাশে আসে।
কিন্তু শৈশব পেরিয়ে কৈশোর ও যৌবনে পদার্পণ করলেও মানুষের চাহিদার অবসান হয় না; কেবল তার ধরন পরিবর্তিত হয়। খ্যাতিমান মনস্তত্ত্ববিদ আব্রাহাম ম্যাসলো মানুষের প্রয়োজনকে একাধিক স্তরে ভাগ করে দেখিয়েছেন। ম্যাসলোর চাহিদার স্তরবিন্যাস তত্ত্বে প্রথমেই আছে শারীরিক প্রয়োজন (যেমন খাদ্য, পানি, আশ্রয়), এরপর নিরাপত্তার প্রয়োজন, তারপর ভালবাসা ও অন্তর্ভুক্তির চাহিদা, পরবর্তীতে স্বীকৃতি ও সম্মানের প্রয়োজন, এবং সর্বশেষে আত্ম-উপলব্ধি বা আত্ম-বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা। এক স্তরের প্রয়োজন কিছুটা পূরণ হলে মানুষ পরবর্তী স্তরের চাহিদা পূরণের জন্য উদগ্রীব হয়। এই ক্রমোন্নত চাহিদাসমূহ ইঙ্গিত করে যে মানুষ কখনোই সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত নয় – জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই কোনো না কোনো অভাব বাকি থেকেই যায়। আসলে কোনো মানুষই শেষ পর্যন্ত তার পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারে না, কেননা মানবস্বভাবের বৈশিষ্ট্যই হলো সবসময় নতুন কিছু অসম্পূর্ণতা বা উন্নতির সুযোগ থেকে যাওয়া । অর্থাৎ নেপোলিয়নের মতো মহাপরাক্রমশালী ব্যক্তিও জীবনে এমন কিছু শূন্যতা রেখে গেছেন যা পূর্ণ হয়নি। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এ এক অন্তহীন চক্র: এক ধরণের চাহিদা পূরণ হলে নতুন আরেকটি চাহিদা জন্ম নেয়। ফলে মানুষ সারাজীবন ধরেই পরিপূর্তির খোঁজে অপূর্ণ হাত বাড়িয়ে চলে, যা রূপক অর্থে ভিক্ষাবৃত্তির সামিল।
মানুষের মানসিক প্রয়োজন শুধু বস্তুগত চাহিদায় সীমাবদ্ধ নয়, সম্পর্ক ও স্বীকৃতির প্রয়োজনও আমাদের প্রাথমিক চালিকা শক্তি শিশুকালে মা-বাবার স্নেহভিক্ষা থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও বন্ধুদের মনোযোগ লাভ, পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে বসের প্রসংশা কিম্বা সমাজে গ্রহণযোগ্যতার অন্বেষণ সবই মানুষের অন্তর্গত নিরাপত্তা ও স্বীকৃতি চাহিদারই প্রকাশ। ভালোবাসা ও অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন মানুষের তৃতীয় প্রাথমিক প্রয়োজন হিসেবেই সংজ্ঞায়িত হয়েছে। ফলে আমরা দেখি, কেউ প্রেমিকের কাছে ভালবাসার প্রার্থনা করছে, কেউ সমাজে মর্যাদা পেতে নিরন্তর পরিশ্রম করছে, আবার কেউ আধ্যাত্মিক শান্তির জন্য ঈশ্বরের আরাধনায় রত আছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ তার চেয়ে বড় কোনো কিছুর কাছ থেকে কিছু প্রাপ্তির আশা করছে – তা স্নেহ, নিরাপত্তা, সম্মান বা পরিত্রাণ যাই হোক না কেন।
সমাজবিজ্ঞান বলছে, মানুষ জন্মগতভাবেই সামাজিক প্রাণী এবং পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। অ্যারিস্টটল বহু শতাব্দী আগে মন্তব্য করেছিলেন যে, সাধারণ সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে জীবনযাপন করতে পারে এমন কেউ যদি থেকে থাকে, তবে সে হয় পশু নয়তো দেবতা – মানুষ নয়। আধুনিক ভাবনায়ও একই সত্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও লেখক আতুল গাওয়ান্ডে বলেন, “মানুষ কেবল সঙ্গ পছন্দ করে বলেই সামাজিক নয়, বরং সহজ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে গেলেও অন্য মানুষের সাথে আন্তঃক্রিয়া আবশ্যক”। অর্থাৎ একাকি একজন মানব সত্তা স্বাভাবিকভাবে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না; তার অস্তিত্ব বিনির্মাণে সামাজিক যোগাযোগ অপরিহার্য। জন্মের পর শারীরিক বেঁচে থাকার জন্য যেমন মা-বাবার সাহায্য চাই, পরবর্তীতে শিখন-প্রক্রিয়ায় গুরুজন