শহীদ রায়হান।
চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক।
মুক্ত সংস্কৃতি বা শিল্পচর্চা বলতে বোঝায় মানুষ নিজের স্বাধীন চিন্তাভাবনা ও আবেগ প্রকাশের স্বাধীনতা — গান, কবিতা, নাটক, সাহিত্য, চিত্রকলা ইত্যাদি মাধ্যমে। স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চা ঐতিহ্য, চেতনা ও গণজাগরণের সেতুবন্ধন; একই সাথে এটি ক্ষমতাসীনদের জন্য অনিরাপত্তার কারণ হতে পারে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংস্কৃতিকে সহজেই দমন করার এক হাতিয়ার হিসেবে দেখে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের একটি কথাসভায় গণমানুষের সাংস্কৃতিক মানুষেরা বলেছিলেন, “স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চার একটি ভয়ের উৎস এখন রাষ্ট্র, আরেকটি উদ্ধত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী”। অর্থাৎ রাষ্ট্র এবং আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীই মুক্ত সংস্কৃতিকে ভয় পায়। এই লেখায় আমরা দেখবো কেন বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক নেতারা মুক্ত সংস্কৃতির স্বাধীনতা থেকে সতর্ক ও ভয় পায়, এবং বিপ্লব সংগ্রামে সংস্কৃতির অবদান কেমন আছে।
সংস্কৃতি এবং রাজনীতি: অন্তর্বর্তী সম্পর্ক
সংস্কৃতি ও রাজনীতির সম্পর্ক অতীতকাল থেকেই দ্বৈত। সংস্কৃতির শক্তি হলো সেটি মানুষের মনকে স্পর্শ করে নতুন স্বপ্ন ও আশা তৈরি করতে পারে। বিপ্লব ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাই শিল্প, সাহিত্য, গান, প্রতীক–সবই জনমানসের মধ্যে জাতীয় চেতনা এবং ঐক্য জাগাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের সময় উদাহরণস্বরূপ নতুন জাতীয় প্রতীকের প্রয়োগ দেখা গেছে। ফরাসি বিপ্লবীদের শিল্প এবং প্রতীক ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল পুরনো রাষ্ট্রবাদী ও ধর্মীয় প্রতীক ভেঙে নতুন গণতান্ত্রিক চেতনা প্রতিষ্ঠা করা। নবগঠিত গণতন্ত্রের প্রতি জনগণ যেন শ্রদ্ধাশীল হতে পারে, তার লক্ষ্যে বিপ্লবীরা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীককে নতুন অর্থে দাড় করান। এক্ষেত্রে গানও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; উদাহরণস্বরূপ ‘লা মার্সেইজ’ জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে বিপ্লবের লক্ষ্যমাত্রা সবারই হৃদয়ে ঢুকিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বায়নের যুগেও দেখা গেছে যে জনসাধারণের চেতনা একত্রিত করার জন্য আলোচনায় সঙ্গীত-নৃত্য-চিত্রকলা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে সংগীত ও গান ‘অনুপ্রেরণার উৎস এবং আন্দোলনকে সক্রিয় করার শক্তিশালী হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার অপ্রতিষ্ঠিক সংগীতশিল্পীরা যেমন পিয়েটার গ্যাব্রিয়েল ও মিরিয়াম মেকবা, দক্ষিণ এশিয়ার ববি ওয়াইন প্রমুখরা সাংস্কৃতির ভুমিকা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান ছড়িয়ে দিয়েছেন । উদ্ভূত-অধীন সাংস্কৃতিক জগতে প্রকাশিত হলো “সংস্কৃতি দিয়ে গণমানুষকে শক্তিশালী করা যায়” এই আদর্শ, তাই মুক্ত সংস্কৃতিক চর্চা থেকে সাবধান থাকতে হয় ক্ষমতাসীনদের।
চলতি শতকের উদাহরণ হিসেবে ইরানের ১৯৭৯-এর ইসলামিক বিপ্লব দেখা যায়। ওই বিপ্লবের পর মৌলবাদী সরকার প্রথম থেকেই গান-সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করে দেয়, সংগীতকে ‘জনসাধারণের মাদক’ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। অর্থাৎ বিপ্লবপরবর্তী শাসক গোষ্ঠী দেখতে চেয়েছিল সংস্কৃতি জনগণকে অস্থির করে ফেলতে পারে। তবুও জনমনে সাংস্কৃতিক চেতনার ঢেউ কমেনি; সংগীত ক্রমশ সামাজিক আলোচনার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। দশকের পর দশক বাদেও ২০০৯ সালের ইরানের গ্রীন আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে ‘উদ্দীপ্ত কোনো সুর বা গান অচেনা মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে দিতে পারে’। অন্যদিকে চীনের বংশবিকাশ শাসনামলে দেখা যায়, মাওসেতু চিন্তায় শিল্প-সংস্কৃতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। মাও কর্তৃক ঘোষিত নীতিতে ‘শিল্পের জন্য শিল্প নেই, সব শিল্পই শ্রেণি-ভিত্তিক ও রাজনীতির অংশ’। ফলে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব (১৯৬৬–৭৬) কালেও শিল্পীদের বাধ্য করা হয় সরকার নির্ধারিত ‘বিপ্লবী চিত্রকলা’ অনুসরণ করতে। সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী উদাহরণ দেখায়: গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বিপ্লবকে শক্তি দেয়, কিন্তু স্বৈরশাসক- শাসকরা সংস্কৃতি নিয়ে শ্রদ্ধাশীল না থেকে বরং শঙ্কিত।
বিশ্ব বিপ্লব সংগ্রামে সংস্কৃতির অবদান
বিপ্লব-স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সাংস্কৃতিক শক্তির অবদান ব্যাপক ও সমৃদ্ধ। আমরা বিভিন্ন অঞ্চলের উদাহরণগুলো দেখে নিতে পারি:
• ফ্রান্স (ইউরোপ): ফরাসি বিপ্লবে নতুন প্রতীক, পোশাক ও গান ব্যবহার করে বিপ্লবের মনোভাব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ‘লা মার্সেইজ’ জাতীয় সংগীত দেশজুড়ে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, যা বিপ্লবীদের মনোবল চাঙ্গা করতে সহায়তা করেছিল। বিপ্লবীরা গণতন্ত্রের আদর্শকে ধর্মীয় ও রাজতান্ত্রিক চিহ্ন থেকে আলাদা করতে সাহিত্যে, শিল্পে পুরনো দেবতা ও রাজাশক্তির প্রতীক ভেঙে নতুন প্রতিক তৈরি করেছিলেন।
• আফ্রিকা: উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে গান ও সঙ্গীত মানুষের সংগ্রামী মনোবিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ায় সংগীতকার ও গায়করা জনজাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। যেমন ইউগান্ডার ববি ওয়াইন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগীত করে তরুণদের মধ্যে সমাবেশ সৃষ্টি করেন, আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষ পরিব্যাপ্ত ‘আলুটা কন্টিনুয়া’ গান নানারঙ্গের জনগণকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছে। আফ্রিকার ইতিহাসে সংগীত গণজাগরণে জায়গা করে নিয়েছিল; মানুষদের মনে আশা জাগায় ও সংগ্রামের মনোবল তৈরি করতে সংগীতকে যুদ্ধে শক্তির মতো ব্যবহার করা হয়েছিল।
• মধ্যপ্রাচ্য: ইরান ছাড়াও মিশর, তিউনিসিয়া ও সিরিয়ায় সাম্প্রতিক আরব বসন্তে খ্রিষ্টান, মুসলিম ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, মিশরের বিপ্লবের সময় হামদ এল-জাহিরসহ তরুণ গায়করা “ঈরহাল” গানে জনগণকে প্রতিবাদে উৎসাহিত করেছিলেন। সংঘর্ষময় পরিস্থিতিতে তারা রাজনৈতিক চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তবে ইরানের মত মৌলবাদি দেশগুলোতে সাংস্কৃতিক মুক্তি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইতিহাস বলে দেয় যে ধর্মনিরপেক্ষ বা গণতান্ত্রিক বিপ্লবে “শিল্প” বিপ্লবের অপূর্ব উৎস হিসেবে কাজ করে, কিন্তু ধর্মীয় স্বৈরাচারের সময় রাষ্ট্র সাংস্কৃতি দমন করে।
• দক্ষিণ এশিয়া: ভারত-বাংলাদেশ অঞ্চলে সাংস্কৃতি রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুভাষচন্দ্র বসুর কবিতা-গান মানুষের মধ্যে সাহস জাগিয়েছিল। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে গানে-সংগীতে দেশপ্রেমের নিদর্শন রাখা হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনীতিকে শক্তি দিয়েছে, যেমন বাংলাদেশে ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় অশনি সংকেত হিসেবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল।
এই উদাহরণগুলো দেখায়, বিশ্বজুড়ে বিপ্লব ও মুক্তির আন্দোলনে সাংস্কৃতি জনমানসকে একত্রিত করতে ও আনন্দ-বেদনার ভাষা হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।যদি কোন রাজনৈতিক পরিবেশে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বেশি বিকশিত হয়েছে, সেখানে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে; আর যেখানে রাজনীতিবিদ বা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগণ সংস্কৃতিকে দমন করেছে, সেখানে জনগণের চিন্তাভাবনা প্রায় নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছে।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে সাংস্কৃতিক চেতনা
ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সংস্কৃতি সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল। গান্ধীজীর নেতৃত্বে গান ও সংগীত প্রচার ছিল জনজীবনে পুনর্জাগরণের একটি মাধ্যম। তিনি নিজে জোর দিয়েছিলেন, “যেখানে সঙ্গীত নেই, সেখানে স্বরাজ নেই”। অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করতেন যে গান জাতীয় চেতনা জাগিয়ে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সংসদীয় গোষ্ঠী কংগ্রেসের অধিবেশনে যখন প্রথম “ভরতো ভাগ্য বিধাতা” গান (জানা গানা মন) সুরেলা হয়, জনগণ তা জাতীয় আবেগের প্রতীক হিসেবে গ্রহন করে। একইভাবে ব্যঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম্’ গান গ্রামীণ সমাজ থেকে শহর অব্দি বিপ্লবের উত্তেজনা ছড়িয়েছিল।
শিল্পী-নাট্যকারেরা আন্দোলনে সরাসরি জড়িত হয়েছেন। আবনিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্ম ‘ভারতমাতা’ ভারতের মুক্তির লক্ষ্যমাত্রাকে আলোকিত করেছিল। নৃত্যশিল্পী রুক্মিণী দেবী অরুন্ধতী ভারতের পুরনো নৃত্যশৈলীতে দেশপ্রেম ও প্রতিরোধের থিম ঢেলে পরিবেশন করতেন, যা দর্শকের মনে ক্রান্তিকালের ছাপ ফেলে। নাট্যদল IPTA (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন) আলোক-নাটক দিয়ে গ্রাম-শহর উভয়ে স্বাধীনতার বার্তা ছড়িয়েছিল। শিল্পীরা শুধু আনন্দ দেওয়ার জন্য নয়, তাদের কর্ম ছিল রাজনৈতিক প্রচারের অংশ – অবিচারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা এবং সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা। অতীতে ব্যবহৃত ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ ও ‘জাতীয় সঙ্গীত’গুলো গণস্বাধীনতার উৎসাহ বিকাশে অমোঘ ভূমিকা রেখেছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সাংস্কৃতি
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। যুদ্ধের সময় সঙ্গীত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জাগিয়ে তুলেছিল। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ রাজনীতির এক চ্যানেল হয়ে দেশের প্রতিটি কোণে মুক্তির গান প্রচার করেছিল। ঐ সময়কার পেশাদার ও অসংগঠিত শিল্পীরা বন্দুক ফেলে সুর তুলেছিলেন। যেমন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ‘শোনা একটি মুজিবর…’, আব্দুল জব্বারের ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গোবিন্দ হালদারের “ মোর একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি” জাতীয় উদ্বুদ্ধিকারক গান হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক শক্তি হয়েছিল। এসব গান জনমনে আশার আলো জোগায় ও গণমানুষকে নিজের অধিকার রক্ষায় সংগঠিত করে ।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুর-সঙ্গীত মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল করেছে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে নিউইয়র্কে “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” আয়োজন করা হয়, যেখানে বিখ্যাত গায়ক জর্জ হ্যারিসন, পন্ডিত রবিশঙ্কর, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টার প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। এটি ছিল মানবিক সহায়তার উদ্দেশ্যে সংগঠিত সঙ্গীতানুষ্ঠানের প্রথম উদাহরণ। এই কনসার্ট পশ্চিমাদের কাছে বাঙালির অবস্থা তুলে ধরেছে এবং ঘনীভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জাগিয়ে তুলেছিল। তাছাড়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত “আমার সোনার বাংলা” গান মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতিকে দশগুণ উজ্জীবিত করে; স্বাধীনতার পর এটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের তরুণ শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীরা ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে দিয়ে গান গেয়ে তাদের উজ্জিবিত করেন।
উপরোক্ত বিষয়সমূহ প্রমাণ করে যে মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক গণআন্দোলন এবং সেখানে সংস্কৃতি শক্তিশালী অঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। যেসব বলিষ্ঠ শিল্পী ও সুরকার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের হাত ধরেই রাজনীতির পণ্ডিতেরা দেশের জনগণের মনে সশস্ত্র সংগ্রামের চেতনা জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন।
রাজনৈতিক নেতাদের ভয় ও প্রতিবন্ধকতা
প্রশ্ন থেকে যায়: এই সব উদাহরণ সত্ত্বেও কেন রাজনীতিবিদরা মুক্ত সংস্কৃতি চর্চা কে ভয় পায়? মূলত তাই যে মুক্ত সংস্কৃতি জনগণের মধ্যে সমালোচনামূলক চেতনা ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে, যা রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ ও নিয়ন্ত্রণের মুখে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সংস্কৃতিবিদ অ্যানিশ কাপুরের কথায়, “সব রক্ষণশীল স্বৈরাচারী সরকারই সংস্কৃতি এবং মুক্তির আত্মার ভয়ে পরিচালিত” । অর্থাৎ যেসব শাসক নীতি, ক্ষমতা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে চান না, তারা সম্ভাব্য বিপ্লবী শক্তিকে রুখতে সংস্কৃতি দমন করে। বাংলাদেশের এক বিশ্লেষণ বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে সবসময়ে এখানে সংস্কৃতিচর্চার প্রতি সরকারের মনোভাব হয়েছিল ‘ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ’। আইন ও নীতির মাধ্যমে সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সংস্কৃতিতে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয় । ফলে স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চা প্রায়ই সরকারী নির্দিষ্ট খাঁচায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায় বা সম্পূর্ণ চুপ করে যায়।
একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবমূর্তি নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসও মুক্ত সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা শিল্পীদের সমর্থন আদায়ে মুখর হয়, অন্যদিকে সরকারবিরোধী শিল্পীদের বিরুদ্ধে হুমকি-সাইপ্রেস চলছে। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে যেসব নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, লেখক সরকারের নিন্দা করেছেন, তাদের কর্মসংসার বা নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এভাবে শিল্পীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে শিল্পী-অভিব্যক্তির বাস্তব অর্থ ও স্বাধীন প্রকাশ সংকুচিত হয়। এক মতামতপত্রে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকেই “শিল্পীদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার” প্রচলিত পথ হয়ে উঠেছে, যা দেশের সংস্কৃতিক উন্নয়নের অবনতি ঘটিয়েছে। অপর দিকে সরকারের সহযোগিতামূলক সংস্কৃতিচর্চাও একটি ফাঁদ। যখন শিল্পীরা রাষ্ট্রীয় তহবিল বা অনুমোদনের উপর নির্ভর করতে শুরু করে, তখন তাঁদের সৃজনশীলতা রাজনৈতিক লক্ষ্যের খাচায় বন্দি হয়ে পড়ে।
এছাড়া কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণও এক বড় বাধা। আধুনিক মিডিয়া ও বিনোদন প্রতিষ্ঠানগুলি কখনো কালচারাল পলিসি অনুসরণ করে, যেখানে জনগণকে বিচ্ছিন্ন রাখতে বা সরাসরি রাজনীতির বিরোধী বার্তা প্রচারের সুযোগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে প্রকাশিত প্রথাগত গান বা কবিতায় যেমন আন্দোলনের সংগীত স্থান পেয়েছে, ধ্রুপদি অর্থনীতিতে তা সংকুচিত শিল্প হয়ে পড়েছে। ফলে ক্ষমতাবানারা সংস্কৃতি-সাহিত্যকে তাদের রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভের প্রতি বিশ্বস্থ রাখতে চান, সত্য ও সমালোচনামূলক কণ্ঠগুলো দমন করতে চান। সংক্ষেপে, মুক্ত সংস্কৃতি জেগে ওঠা মানে মানুষের মধ্যে সমালোচনার চেতনা জন্ম – যা ক্ষমতাসীনদের জন্য বিপজ্জনক তাই তারা মুক্ত সংস্কৃতিক চর্চাকে আষ্ঠেপিষ্ঠে বেঁধে রাখেন।
অতীত থেকে বর্তমানের উদাহরণগুলো স্পষ্ট দেখায়: সংস্কৃতির কাজ হলো সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, মুক্তচিন্তার বিস্তার ঘটানো। বিপ্লবের সময় সংস্কৃতির উন্মুক্ত চর্চা মানুষকে নেতৃত্ব দিয়েছে, যেমন ভারত ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দেখিয়েছে। ভিন্নতাবাদী শিল্পীরা গণজাগরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ; কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এসব স্বাধীনতা থেকে ঘাবড়ে যায়। তারা সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখার চেষ্টা করে যাতে সাংস্কৃতিক মাধ্যমে ক্ষমতা বিরোধী বার্তা ছড়াতে না পারে। পাকিস্তান পরাজিত হওয়া ১৯৭১-এর ইতিহাস দেখালো, শাসক যখন জনগণের শক্তি উপেক্ষা করেন, সংস্কৃতির শক্তি তখন প্রকট হয়ে ওঠে। তাই মুক্ত সংস্কৃতি চর্চায় স্বচ্ছতা ও সহনশীলতা রাজনীতিবিদদের জন্য সুযোগ হতে পারে, কিন্তু তারা এ সুযোগকে মেনে নিতে ভয় পান। সমাজের সমৃদ্ধির জন্য মুক্ত সংস্কৃতি জরুরি হলেও রাজনীতিবিদরা নিজেরা আদর্শ পরিবর্তন ছাড়াই তা যেন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। এই অবস্থায় প্রয়োজন সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও শিল্পীদের সুরক্ষা আইনগতভাবে নিশ্চিৎ করার, যাতে সংস্কৃতি রাজনীতির পকেট থেকে বের হয়ে জনগণের মুক্তির সেতুবন্ধন গড়ে দিতে পারে। জনমুক্তির ভাষা ও শক্তি হয়ে মুক্ত সংস্কৃতির চর্চা যেনো দেশ ও জাতীর উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।